শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন
শাকিব বিপ্লব ॥ দলের মধ্যেকার তোষামোদিতে অভ্যস্ত বিশাল একটি গ্রুপ সাদিক আবদুল্লাহর চারপাশে অবস্থান নিয়েছে। মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তরুণ এই রাজনীতিবিদের কিভাবে কাছাকাছি থাকা যায় অথবা সুনজরে আসার জন্য জান-পরান দিয়ে নানা কৌশল প্রয়োগ শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে সাদিক-বন্দনাই হচ্ছে এখন মূল অস্ত্র। পাশাপাশি বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারকে অনায়াসে পরাজয় এবং বিপুল ভোটে বিজয়কে সাদিকের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন হিসেবে তুলে ধরে যেভাবে বন্দনা শুরু করেছে, তাতে এই নেতাকে প্রশংসায় পর্বতের চূড়ায় উঠিয়ে দিতে দিন-রাত চলছে প্রতিযোগিতা।
কেউ কেউ সাদিককে ইতিমধ্যে জাতীয় অনেক নেতার সাথেও তুলনা করা শুরু করেছে। এদের উদ্দেশ্য সুদূর প্রসারিত এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। চাকুরীর ক্ষেত্রে সুবিধা এবং পদোন্নতির প্রত্যাশায় কালীবাড়ি মুখে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় সাদিক আবদুল্লাহ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও তিনিও উপলব্ধিতে এনেছেন, এতো প্রশংসা ভালো নয়। এসব তথ্য দিয়ে দলীয় কুশীলবরা বলছে, সাদিককে ভিন্ন পথে নেওয়ার অপচেষ্টা এখনই শুরু হয়ে গেছে। লক্ষণ শুভ নয় বলে তারা মনে করছে।
দলের এই অংশটি উদাহরণ টেনে বলছে, প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন ২০০৮ সালে প্রথম মেয়র আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে বরিশাল সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ঠিক এভাবেই তোষামোদিরা হিরনকে গ্রাস করে ফেলেছিল। শুধু দলের একটি অংশই নয়, বরিশাল শহর ও শহরের বাইরের অনেক ব্যবসায়ীরা তার চারপাশে কৌশলে অবস্থান নিয়ে ফায়দা লোটে এবং কয়েক বছরের মধ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হন। এর মধ্যে দলীয় তোষামোদিদের আর্থিক উত্থান ছিল বিস্ময়কর। অবশ্য এক্ষেত্রে তরুণ কিছু ছাত্র নেতার অবস্থান ছিল অগ্রগামী। সেই আদলেই সাদিককে ঘিরে ধরেছে তোষামোদিরা। সিটি কর্পোরেশন থেকে ঠিকাদারী এবং নানা সেক্টরে মেয়রের দ্বারা সুপারিশ রেখে কিভাবে ফায়দা লোটা যায় তারই প্রাক-প্রস্তুতিতে সাদিকের মন জয়ে নানামুখি চেষ্টার অংশই হচ্ছে তোষামোদি।
একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারাই বেশিমাত্রায় তোষামোদিতে সাদিককে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখতে শুরু করেছে। পাশাপাশি রয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সিরিয়াল। তবে সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারাও পিছিয়ে নেই। এদের মধ্যে অন্তত তিন জনের কথা জানা যায়। যারা বরিশাল সদর আসনে সংসদীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এরা বর্তমানে দুই কূল সমান রেখে তোষামোদি শুরু করেছে। একদিকে সাদিক, অন্যদিকে তার পিতা মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে যাতায়াত বৃদ্ধিসহ সাদিকের সাথে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। এদের টার্গেট- অন্তত পুত্র সাদিককে ম্যানেজ করতে পারলেই আবুল হাসানাতকে রাজি-খুশি করা সহজতর হবে। তবে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের তোষামোদি এবং নানামুখি বুদ্ধি-পরামর্শে সাদিক আবদুল্লাহকে বিতর্কিত পথে নিয়ে যাওয়ার আশংকা প্রবল করে তুলেছে বলে মনে করছে দলের সুশীল অংশটি। বাস্তবে যদি তাই ঘটে এবং এই চাটুকর নেতারা যদি তাদের পরিকল্পনায় শতভাগ সফল হয় তবে বরিশাল প্রেক্ষাপটে সাদিক ইমেজ সংকটে পড়তে পারে।
যেমন শওকত হোসেন হিরন এ ধরনের দলীয় তোষামোদিদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ছাত্র-যুবলীগের শীর্ষ সারির নেতারা তৎসময়ে হিরনকে ব্যবহার করে রাতারাতি কোটিপটি হন। সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রভাব বিস্তার করে ঠিকাদারী নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। উদার রাজনীতির প্রতীকৃত হিরন প্রভাবিত হলেও সংঘাতের রাজনীতিতে কাউকে বেশিদূর অগ্রসর দেননি। কিন্তু এই তোষামোদিদের কারণেই দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে একটি গ্রুপকে চেপে ধরে রাখার কৌশলী পথে হাটতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার খেসারতও দিয়ে গেছেন প্রয়াত এই নেতা। পরবর্তী সিটি নির্বাচনে একাকী হয়ে পড়েন এবং বিএনপি নেতা কামালের কাছে তার পরাজয় ত্বরান্বিত হয়। অনেকের আশংকা রাজনীতিতে নবীন সাদিক আবদুল্লাহ হিরনের ন্যায় অতটা দূরদর্শী নয়। তবে তিনি হিরনের অনুকরণে রাজনীতিতে নিজের ছায়া দেখতে চাচ্ছেন ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মকান্ডে তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। কিন্তু তার চারপাশে থাকা তোষামোদিদের ভ্রান্ত রাজনীতি থেকে কতটুকু মুক্ত থাকতে পারবেন তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তবে কেউ কেউ মনে করছে এই তোষামোদিরাই তরুণ এই মেয়রকে ব্যবহার করে শুধু আর্থিকভাবে লাভবান নয়, বরিশাল রাজনীতিতে সংঘাত এবং প্রতিহিংসার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় কিনা সেই শংকা প্রবল হয়ে উঠেছে নগরবাসীর মধ্যে। এর আরও একটি কারণ হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যেকার একটি অংশ সাদিক আবদুল্লাহর মন জয় করতে যার যার অবস্থান থেকে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে। ফলে তোষামোদিদের সাথে এদের ঐক্যের সমন্বয় ঘটলে আইন-শৃঙ্খলা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যদি কিনা ক্যাডার রাজনীতি নতুন মাত্রা পায়। এক্ষেত্রে সাদিক আবদুল্লাহ নিজের ভারসাম্য কতটুকু রক্ষা করতে পারবেন, সে প্রশ্নটি এখন নগরবাসীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদিক-ঘনিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, তরুণ এই মেয়র রাজনীতিতে অতটা দূরদর্শী না হলেও নিজের ইমেজের প্রশ্নে বেশ সতর্ক। নির্বাচন-উত্তর বিজয়ের আমেজে তোষামোদিদের আপাতত আশ্রয় দিলেও শেষমেষ তাদের কালীবাড়ি ছাড়তে হতে পারে বলে ওই সূত্রটি আভাস দেয়।
মূলত সাদিক তার রাজনীতির শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরী এবং সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে অনেককেই তার আশেপাশে ভিড়তে সহজতর করে দিলেও বর্তমানে তিনি বাদবিচার শুরু করেছেন। সাদিক চাইছেন- হিরন স্টাইলের রাজনীতি আবার বরিশালে প্রত্যাবর্তন। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তিনি যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন তার প্রতিফলন দেখাতে চান। কিন্তু হিরনের ন্যায় কিছু ভুল পথে হাটতে নারাজ বলে তার বিশ্বস্তদের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে উঠেছে তাকে ব্যবহার করে কেউ যেন আখের গোছাতে না পারে। আবার ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে বিতর্কের মধ্যে যেতেও নারাজ। যে কারণে তিনি আগেভাগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সংঘাত ও মাদকের বিষয়ে কোন ছাড় দেবেন না। জানা যায়, তোষামোদকারীরা এতটাই সাদিকের মুখোমুখি বন্দনা শুরু করেছে যে এই নেতাকে উস্কে দিতে চাইছে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মাঠছাড়া করার প্রথম পদক্ষেপ নিতে।
কিন্তু সাদিককে প্রভাবিত করা অতটা সহজ নয় বলে প্রাথমিক একটি ধারণা তৈরী করে দিয়েছেন। যেমন বিজয় লাভের পর অতিউৎসাহীরা নগরীতে বড় ধরনের শোডাউন হিসেবে বিজয় মিছিল এবং দলে দলে ফুলের মালা দেওয়ার উদ্যোগ তিনি বাতিল করে দেন। কৌশল হিসেবে নেতা-কর্মীদের জানিয়ে দেন, শোকের মাস আগস্টে এ ধরনের কোন কর্মসূচি তিনি নেবেন না। পাশাপাশি আরো একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। নির্বাচনের পরপরই পরাজিত বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার ও ইসলামী আন্দোলনের ওবায়দুর রহমান মাহবুবের সাথে সাদিক আবদুল্লাহ সৌজন্য সাক্ষাতে উভয়ের বাসভবনমুখি হন। এই পদক্ষেপকে সাদিক আবদুল্লাহ যে দূরদর্শী তার ছাপ বলে মনে করছে ঘনিষ্টজনেরা। এখন দেখার বিষয় আগামি ৫ বছর সাদিক তার ক্ষমতার ভারসাম্য কতটুটু ধরে রাখতে সক্ষম হন।
Leave a Reply